টিভি নাটক

টিভি নাটক

বাংলাদেশে টিভি নাটকের শুরু এবং এর বিকাশ একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। টিভি নাটক এদেশের মানুষের বিনোদনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে, যখন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশন (ইপিটিভি) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র এবং বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামে পরিচিত। ইপিটিভির মাধ্যমে দেশের মানুষ প্রথমবারের মতো টেলিভিশন নাটকের স্বাদ পায়, যা তৎকালীন সময়ে সাংস্কৃতিক বিনোদনের ক্ষেত্রে একটি বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে।

১৯৬৪ সালে ইপিটিভির আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের পর নাটক প্রচারের ধারা শুরু হয়। প্রথম দিকের নাটকগুলোর মধ্যে মনিরুল ইসলামের লেখা “তিন গোয়েন্দা” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নাটক মূলত স্টুডিও পরিবেশে ধারণ করা হতো এবং সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। এ সময়ে নাটকের বিষয়বস্তু ছিল সামাজিক ও পারিবারিক গল্প কেন্দ্রিক, যা দর্শকদের সহজেই আকৃষ্ট করত।

সত্তরের দশকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর টিভি নাটকের ধারা আরও বিস্তৃত হয়। দেশজুড়ে টেলিভিশনের বিস্তার এবং দর্শকদের আগ্রহ বৃদ্ধির ফলে নাটকের সংখ্যা ও মান উভয়ই উন্নত হতে থাকে। এই সময়ে বিটিভি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে “সংশপ্তক,” “এইসব দিনরাত্রি,” এবং “কোথাও কেউ নেই” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নাটক শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজের নানা বিষয় নিয়ে ভাবনা-জাগানো বার্তা প্রদান করত।

আশির দশককে বাংলা টিভি নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ সময়ে নাটকের গল্প, নির্মাণশৈলী এবং অভিনয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়। “অয়োময়,” “বহুব্রীহি,” এবং “কোথাও কেউ নেই” এর মতো নাটক এই সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও পরিচালিত নাটক এ সময়ে দর্শকদের মন জয় করে নেয়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেমন বাকের ভাই, মেজর এবং মিসির আলি আজও দর্শকদের মনে অমলিন হয়ে আছে। এই সময়ে নাটকগুলোর বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য আসে; সামাজিক গল্পের পাশাপাশি রহস্য, হাস্যরস এবং দার্শনিক ভাবনাও উঠে আসে।

নব্বইয়ের দশকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমন টিভি নাটকের জগতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। একাধিক বেসরকারি চ্যানেলের আবির্ভাবের ফলে নাটক নির্মাণে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং মানের উন্নতি হয়। চ্যানেল আই, এনটিভি, এটিএন বাংলা এবং মাছরাঙা টিভির মতো চ্যানেলগুলো নাটক প্রচারের নতুন ধারা চালু করে। এ সময়ে বিভিন্ন প্রজন্মের নির্মাতা ও অভিনেতারা টিভি নাটকের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পান।

২০০০-এর দশকে টিভি নাটক নির্মাণে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নাটকের চিত্রায়ন ও সম্পাদনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এ সময়ে দর্শকরা আরও উন্নত প্রযোজনা মানের নাটক দেখতে পান। হানিফ সংকেতের “ইত্যাদি” এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ব্যাচেলর” নাটক এ সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

টিভি নাটক দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নারী অধিকার, সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক সম্পর্ক, এবং রাজনৈতিক বিষয়বস্তুকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দর্শকদের চিন্তাভাবনা ও মনোভাব গঠনে এসব নাটকের প্রভাব অপরিসীম।

বর্তমান সময়ে ওটিটি (ওভার-দ্য-টপ) প্ল্যাটফর্মের উত্থানের ফলে টিভি নাটকের চাহিদা কিছুটা কমে গেলেও এর গুরুত্ব এখনও অটুট। বেসরকারি চ্যানেলগুলো এখনও মানসম্পন্ন নাটক নির্মাণে সচেষ্ট। পাশাপাশি ইউটিউব এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও নাটক প্রচারিত হচ্ছে, যা নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছে সহজলভ্য।

বাংলাদেশে টিভি নাটকের সাফল্যের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের অবদান কখনও অস্বীকার করা যায় না। লেখক, পরিচালক, অভিনেতা এবং প্রযোজকরা মিলে নাটকের মাধ্যমে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের টিভি নাটক এদেশের মানুষের বিনোদন এবং সামাজিক সচেতনতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। যুগের পর যুগ ধরে এই মাধ্যমটি দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছে এবং এখনও এর জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নতুন মাধ্যমের উত্থান সত্ত্বেও টিভি নাটক এদেশের সাংস্কৃতিক জগতের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে থাকবে।

 

Leave a Reply