মঞ্চ নাটক

মঞ্চ নাটক

বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের ইতিহাস, বিকাশ এবং গুরুত্ব অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও বিনোদন শিল্পে মঞ্চ নাটক একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু বিনোদনের জন্য নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে মঞ্চ নাটক দেশের সাংস্কৃতিক চেতনা এবং শিল্পকলার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলায় মঞ্চ নাটকের যাত্রা মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। কলকাতায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ নাট্যকার ও নির্দেশকদের হাত ধরে বাংলা মঞ্চ নাটকের ভিত্তি তৈরি হয়। দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নাটক তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের অঞ্চলে মঞ্চ নাটকের বিস্তার শুরু হয় বিশ শতকের প্রথমার্ধে।

পূর্ব পাকিস্তান আমলে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ, মঞ্চ নাটকের চর্চা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়। এ সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে কিছু নাট্যদল গঠিত হয়, যারা মঞ্চ নাটকের চর্চা শুরু করে। এসব নাটক মূলত সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং ব্রিটিশ বিরোধী ভাবধারা তুলে ধরত। শিল্পকলার এই মাধ্যমটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সাংস্কৃতিক মুক্তির ধারায় মঞ্চ নাটক হয়ে ওঠে জনগণের স্বর। ঢাকা থিয়েটার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল এবং পদাতিক নাট্যদলসহ বিভিন্ন দল গঠিত হয়। এ সময়ে নাটক নির্মাণে একজন প্রগতিশীল ও সমাজ সচেতন চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যায়। শিল্পী ও নির্দেশক সেলিম আল দীনের নাম বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি “কীত্তনখোলা,” “কেরামত মঙ্গল,” এবং “হাত হদাই” নাটকের মাধ্যমে বাংলা মঞ্চ নাটকে একটি নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন। তাঁর নাটকগুলো লোকজ ঐতিহ্য এবং বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে রচিত হয়।

আশি ও নব্বইয়ের দশককে বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ সময়ে মঞ্চ নাটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন নাট্যদল গঠিত হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়মিত নাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়। নাটকগুলোর বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য আসে; সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু নাটকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে ছিল আবদুল্লাহ আল মামুনের “মেরাজ ফকিরের মা,” মামুনুর রশীদের “শিল্পী,” এবং আতাউর রহমানের “গ্যালিলিও।” এই নাটকগুলো শুধু দর্শকদের বিনোদন দেয়নি, বরং সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে।

বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক আজও বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়। ঐতিহ্যবাহী লোকজ নাটক যেমন কীত্তনখোলা, বাউলগান এবং পালাগান থেকে শুরু করে আধুনিক থ্রিলার ও সামাজিক নাটক মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। এসব নাটকে জীবনের নানা দিক যেমন হাস্যরস, মানবিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম তুলে ধরা হয়।

মঞ্চ নাটক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাগরণের অন্যতম মাধ্যম। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন আন্দোলন, যেমন গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নারী অধিকার আন্দোলনে মঞ্চ নাটকের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নাট্যদলগুলো সরাসরি রাজপথে নাটক পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। “গণনাট্য সংঘ” এ ধরনের কর্মকাণ্ডের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিকাশ ও ডিজিটাল মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে মঞ্চ নাটকের দর্শকসংখ্যা কিছুটা কমে গেছে। তবে এখনো বিভিন্ন নাট্যদল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মঞ্চ নাটকের চর্চা অব্যাহত রেখেছে। শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত নাটকের প্রদর্শনী হয়। নতুন প্রজন্মের নাট্যকার ও নির্দেশকরা মঞ্চ নাটকে নতুন নতুন বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলী নিয়ে আসছেন।

মঞ্চ নাটকের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত দর্শক না পাওয়া এবং অর্থায়নের অভাব। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্যও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি সম্ভাবনাও কম নয়। বর্তমানে অনেক নাট্যদল তরুণ প্রজন্মকে নাটকের প্রতি আকৃষ্ট করতে কাজ করে যাচ্ছে। নাটকের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, নারীর অধিকার এবং পরিবেশ সচেতনতা উঠে আসছে, যা দর্শকদের কাছে নতুন করে আবেদন সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশে মঞ্চ নাটক শুধু একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক। এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানবিক মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করেছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ নাটক তার রূপ ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটালেও এর গুরুত্ব আজও অপরিসীম। প্রযুক্তির এই যুগেও মঞ্চ নাটক তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে, যদি নতুন প্রজন্ম এটির প্রতি আগ্রহী হয় এবং সরকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যথাযথ সহায়তা প্রদান করে।

Leave a Reply